![]() |
SA Shabuj Islam |
তুমি চলে যাচ্ছো-
নির্মেলেন্দু গুণ
=================
তুমি চলে যাচ্ছো
নদীতে কল্লোল তুলে লঞ্চ ছাড়ছে
কালো ধোঁয়ার ধস ধস আওয়াজের ফাঁকে ফাঁকে
তোমার ক্লান্ত অপস্রিয়মাণ মুখস্রী
সেই কবে থেকে
তোমার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রয়েছি
তুমি চলে যাচ্ছো
তোমার চলে যাওয়া শেষ হচ্ছে না
সেই কবে থেকে তুমি যাচ্ছো তবু শেষ হচ্ছে না
তবু শেষ হচ্ছে না
বাতাসের সঙ্গে কথা বলে
বৃষ্টির সঙ্গে কথা বলে
ধলেস্বরীর দিকে চোখ ফিরাতেই
তোমাকে আবার দেখলুম
আবার নতুন করে তোমার চলে যাওয়া শুরু
তুমি চলে যাচ্ছো
নদীতে কল্লোল তুলে লঞ্চ ছাড়ছে
কালো ধোঁয়ার ফাঁকে ফাঁকে
তোমার ক্লান্ত অপস্রিয়মাণ মুখস্রী
যেনো আমার সেই প্রথমবারের মতো চলে যাওয়া
তুমি চলে যাচ্ছো
আমি দুই চোখে তোমার চলে যাওয়ার দিকে
তাকিয়ে রয়েছি তাকিয়ে রয়েছি
তুমি চলে যাচ্ছো
নদীতে কান্নার কল্লোল
তুমি চলে যাচ্ছো
বাতাসে মৃত্যুর গন্ধ
তুমি চলে যাচ্ছো
চৈতন্যে অস্থির দোলা
লঞ্চ ছাড়ছে টারবাইনে বিদ্যুৎ গতি
ঝর তুলছে প্রানের বৈঠায়
কালো ধুঁয়ার দুরত্ব চিরে চিরে
ভেসে উঠছে তোমার অপস্রিয়মাণ মুখস্রী
তুমি ডুবতে ডুবতে ভেসে উঠছো
তোমার চলে যাওয়া কিছুতেই শেষ হচ্ছে না
তিন হাযার দিন ধরে তুমি যাচ্ছো যাচ্ছো আর যাচ্ছো
তুমি চলে যাচ্ছো আকাশ ভেঙ্গে পড়ছে
তরঙ্গিত নদীর জ্যোৎস্নায়
কালো রাজহংশের মতো তোমার নৌকো
কাঁশ বনের বুক চিঁরে চিঁরে আখ ক্ষেতের পাশ দিয়ে যাচ্ছে
অজানা ভুবনের ডাকে
তুমি চলে যাচ্ছো আকাশ ভেঙ্গে পড়ছে আকাশের মতো
হে তরঙ্গ
হে সর্বগ্রাসী নদী
হে নিষ্ঠুর কালো নৌকো
তোমরা মাথায় তুলে যাকে নিয়ে যাচ্ছো
সে আমার কিছুই ছিলো না
তবু কেনো সন্ধের আকাশ
এভাবে ভেঙ্গে পড়লো নদীর জ্যোৎস্নায়
ভেঙ্গে পড়লো জলের অতলে তুমি চলে যাচ্ছো বলে
তুমি চলে যাচ্ছো
ল্যাম্পোষ্ট থেকে খসে পড়ছে বাল্ব
সমস্ত শহর জুড়ে নেমে আসছে
মাটির নিচের গাঢ় তমাল তমশা
যেনো কোনো বিজ্ঞ যাদুকর কালো স্কার্ফ দিয়ে
এ শহর দিয়েছে মুড়িয়ে
দু একটা বিষণ্ণ ঝিঁ ঝিঁ ছাড়া আর কোনো গান নেই
শব্দ নেই জীবনের শিল্প নেই
নেই কোনো প্রাণের সঞ্চার
এ শহর অন্ধ করে তুমি চলে যাচ্ছো
আর এক দুরের নগরে
আমি সেই নগরীর কাল্পনিক
কিছু আলো চোখে মেখে নিয়ে
তোমার গন্তব্যের দিকে নিলীমায় রয়েছি
তুমি চলে যাচ্ছো
তোমার বিদায়ি চোখে চশমায় নূহের প্লাবণ
তুমি চলে যাচ্ছো
বিউগলে বিষণ্ণ সুর ঝর তুলছে অন্তরগত অশোক কাননে
তুমি চলে যাচ্ছ
তোমার পশ্চাতে এক রিক্ত নিঃস্ব মৃতের নগরী পড়ে আছে
অনন্ত অস্থির চোখে বেদনার মেঘ জমে আছে
তোমার মুখের দিকে তাকাতে পারিনা
তোমাকে দেখার নামে
তোমার চতুর্দিকে পরিপার্শ্ব দেখি
বিমান বন্দরে বৃষ্টি
দুচোখ জলের কাছে ছুটে যেতে চায়
তোমার চোখের দিকে তাকাতে পারিনা
তুমি চলে যাচ্ছো
আমার কবিতা গুলো শরবিদ্ধ
আহত সিংহের ক্ষোভ বুকে নিয়ে পড়ে আছে একা
তুমি চলে যাচ্ছ ,কতোগুলি শব্দের চোখে ।
তোমার চোখ এত লাল কেন
নির্মলেন্দু গুণ
==================================
আমি বলছি না ভালবাসতেই হবে, আমি চাই
কেউ
একজন আমার জন্য অপেক্ষা
করুক,
শুধু
ঘরের ভিতর থেকে দরোজা
খুলে দেবার জন্য।
বাইরে
থেকে দরোজা খুলতে খুলতে
আমি এখন ক্লান্ত।
আমি
বলছি না ভালবাসতেই হবে,
আমি চাই
কেউ
আমাকে খেতে দিক।
আমি হাতপাখা নিয়ে
কাউকে
আমার পাশে বসে থাকতে
বলছি না,
আমি
জানি, এই ইলেকট্রিকের যুগ
নারীকে
মুক্তি দিয়েছে স্বামী-সেবার
দায় থেকে।
আমি
চাই কেউ একজন জিজ্ঞেস
করুক;
আমার
জল লাগবে কি
না, নুন লাগবে কি
না,
পাটশাক
ভাজার সঙ্গে আরও একটা
তেলে
ভাজা শুকনো মরিচ লাগবে
কি না।
এঁটো
বাসন, গেঞ্জি-রুমাল আমি
নিজেই ধুতে পারি
আমি
বলছি না ভালবাসতেই হবে,
আমি চাই
কেউ
একজন ভিতর থেকে আমার
ঘরের দরোজা
খুলে
দিক। কেউ
আমাকে কিছু খেতে বলুক।
কাম-বাসনার সঙ্গী না
হোক, কেউ অন্তত আমাকে
জিজ্ঞেস করুক : ‘তোমার চোখ এতো লাল কেন?’
তাহারেই পড়ে মনে
সুফিয়া কামাল
=====================
হে কবি! নীরব কেন-ফাল্গুন যে এসেছে ধরায়,
বসন্তে
বরিয়া তুমি লবে না
কি তব বন্দনায়?
কহিল
সে স্নিগ্ধ আঁখি
তুলি-
দখিন
দুয়ার গেছে খুলি?
বাতাবী
নেবুর ফুল ফুটেছে কি?
ফুটেছে
কি আমের মুকুল?
দখিনা
সমীর তার গন্ধে গন্ধে
হয়েছে
কি অধীর আকুল?
এখনো দেখনি তুমি?
কহিলাম
কেন কবি আজ
এমন
উন্মনা তুমি?
কোথা
তব নব পুষ্পসাজ?
কহিল
সে সুদূরে চাহিয়া-
অলখের
পাথার বাহিয়া
তরী
তার এসেছে কি?
বেজেছে
কি আগমনী গান?
ডেকেছে
কি সে আমারে?
-শুনি
নাই,রাখিনি সন্ধান।
কহিলাম
“ওগো কবি, রচিয়া লহ
না আজও গীতি,
বসন্ত-বন্দনা তব কণ্ঠে
শুনি-এ মোর
মিনতি।
কহিল
সে মৃদু মধুস্বরে-
“নাই
হ’ল, না
হোক এবারে-
আমার
গাহিতে গান! বসন্তরে আনিতে
ধরিয়া-
রহেনি,সে ভুলেনি তো,
এসেছে
তো ফাল্গুন স্মরিয়া।”
কহিলাম
“ওগো কবি, অভিমান করেছ
কি তাই?
যদিও
এসেছে তবু তুমি তারে
করিলে বৃথাই।”
কহিল
সে পরম হেলায়-
“বৃথা
কেন? ফাগুন বেলায়
ফুল
কি ফোটে নি
শাখে?
পুষ্পারতি
লভে নি কি ঋতুর
রাজন?
মাধবী
কুঁড়ির বুকে গন্ধ নাহি?
করে
নি সে অর্ঘ্য
বিরচন?”
“হোক, তবু বসন্তের প্রতি
কেন
এই
তব তীব্র বিমুখতা?”
কহিলাম
“উপেক্ষায় ঋতুরাজে
কেন
কবি দাও তুমি ব্যথা?”
কহিল
সে কাছে সরি
আসি-
“কুহেলী
উত্তরী তলে মাঘের সন্ন্যাসী-
গিয়াছে
চলিয়া ধীরে পুষ্পশূন্য দিগন্তের
পথে
রিক্ত
হস্তে। তাহারেই
পড়ে মনে,
ভুলিতে
পারি না কোন মতে।”
কান্ডারি হুসিয়ার
কাজি নজরুল ইসলাম
======================
দুর্গম গিরি, কান্তার-মরু, দুস্তর পারাবার
লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি-নিশীথে, যাত্রীরা হুশিয়ার!
দুলিতেছে
তরি, ফুলিতেছে জল, ভুলিতেছে
মাঝি পথ,
ছিঁড়িয়াছে পাল, কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মৎ?
কে আছ জোয়ান হও আগুয়ান হাঁকিছে ভবিষ্যৎ।
এ তুফান ভারী, দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার।
তিমির
রাত্রি, মাতৃমন্ত্রী সান্ত্রীরা সাবধান!
যুগ-যুগান্ত সঞ্চিত ব্যথা ঘোষিয়াছে অভিযান।
ফেনাইয়া উঠে বঞ্চিত বুকে পুঞ্জিত অভিমান,
ইহাদের পথে নিতে হবে সাথে, দিতে হবে অধিকার।
অসহায়
জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে
না সন্তরন
কান্ডারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তি পন।
হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?
কান্ডারী! বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার
গিরি
সংকট, ভীরু যাত্রীরা গুরু
গরজায় বাজ,
পশ্চাৎ-পথ-যাত্রীর মনে সন্দেহ জাগে আজ!
কান্ডারী! তুমি ভুলিবে কি পথ? ত্যজিবে কি পথ-মাঝ?
করে হানাহানি, তবু চলো টানি, নিয়াছ যে মহাভার!
কান্ডারী!
তব সম্মুখে ঐ
পলাশীর প্রান্তর,
বাঙালীর খুনে লাল হল যেথা ক্লাইভের খঞ্জর!
ঐ গঙ্গায় ডুবিয়াছে হায়, ভারতের দিবাকর!
উদিবে সে রবি আমাদেরি খুনে রাঙিয়া পূনর্বার।
ফাঁসির
মঞ্চে গেয়ে গেল যারা
জীবনের জয়গান,
আসি অলক্ষ্যে দাঁড়ায়েছে তারা, দিবে কোন্ বলিদান
আজি পরীক্ষা, জাতির অথবা জাতের করিবে ত্রাণ?
দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, কান্ডারী হুশিয়ার!
বিদ্রহী-
কাজি নজরুল ইসলাম
===================
বল বীর –
বল উন্নত মম শির!
শির নেহারি’ আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির!
বল বীর –
বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি’
চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি’
ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া
খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া,
উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ববিধাতৃর!
মম ললাটে রুদ্র ভগবান জ্বলে
রাজ-রাজটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর!
বল বীর –
আমি চির উন্নত শির!
আমি
চিরদূর্দম, দুর্বিনীত, নৃশংস,
মহা- প্রলয়ের আমি নটরাজ,
আমি সাইক্লোন, আমি ধ্বংস!
আমি মহাভয়, আমি অভিশাপ পৃথ্বীর,
আমি দুর্বার,
আমি ভেঙে করি সব চুরমার!
আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল,
আমি দ’লে যাই যত বন্ধন,
যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল!
আমি মানি না কো কোন আইন,
আমি ভরা-তরী করি ভরা-ডুবি,
আমি টর্পেডো, আমি ভীম ভাসমান মাইন!
আমি ধূর্জটি, আমি এলোকেশে ঝড় অকাল-বৈশাখীর
আমি বিদ্রোহী, আমি বিদ্রোহী-সুত বিশ্ব-বিধাতৃর!
বল বীর –
চির-উন্নত মম শির!
আমি
ঝন্ঝা, আমি ঘূর্ণি,
আমি পথ-সমূখে যাহা পাই যাই চূর্ণি’।
আমি নৃত্য-পাগল ছন্দ,
আমি আপনার তালে নেচে যাই,
আমি মুক্ত জীবনানন্দ।
আমি হাম্বার, আমি ছায়ানট, আমি হিন্দোল,
আমি চল-চঞ্চল, ঠমকি’ ছমকি’
পথে যেতে যেতে চকিতে চমকি’
ফিং দিয়া দিই তিন দোল;
আমি চপলা-চপল হিন্দোল।
আমি তাই করি ভাই যখন চাহে এ মন যা,
করি শত্রুর সাথে গলাগলি,
ধরি মৃত্যুর সাথে পান্জা,
আমি উন্মাদ, আমি ঝন্ঝা!
আমি মহামারী আমি ভীতি এ ধরিত্রীর;
আমি শাসন-ত্রাসন,
সংহার আমি উষ্ন চির-অধীর!
বল বীর
আমি চির উন্নত শির!
আমি
চির-দুরন্ত দুর্মদ,
আমি দুর্দম,
মম প্রাণের পেয়ালা হর্দম হ্যায় হর্দম ভরপুর মদ।
আমি
হোম-শিখা, আমি সাগ্নিক
জমদগ্নি,
আমি যজ্ঞ, আমি পুরোহিত, আমি অগ্নি।
আমি সৃষ্টি, আমি ধ্বংস,
আমি লোকালয়, আমি শ্মশান,
আমি অবসান, নিশাবসান।
আমি ইন্দ্রাণী-সুত হাতে চাঁদ ভালে সূর্য
মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর রণ-তূর্য;
আমি কৃষ্ন-কন্ঠ, মন্থন-বিষ পিয়া ব্যথা-বারিধীর।
আমি ব্যোমকেশ, ধরি বন্ধন-হারা ধারা গঙ্গোত্রীর।
বল বীর
চির উন্নত মম শির!
আমি
সন্ন্যাসী, সুর-সৈনিক,
আমি যুবরাজ, মম রাজবেশ ম্লান গৈরিক।
আমি বেদুঈন, আমি চেঙ্গিস,
আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্ণিশ!
আমি বজ্র, আমি ঈশান-বিষাণে ওঙ্কার,
আমি ইস্রাফিলের শিঙ্গার মহা হুঙ্কার,
আমি পিণাক-পাণির ডমরু ত্রিশূল, ধর্মরাজের দন্ড,
আমি চক্র ও মহা শঙ্খ, আমি প্রণব-নাদ প্রচন্ড!
আমি ক্ষ্যাপা দুর্বাসা, বিশ্বামিত্র-শিষ্য,
আমি দাবানল-দাহ, দাহন করিব বিশ্ব।
আমি প্রাণ খোলা হাসি উল্লাস,
আমি সৃষ্টি-বৈরী মহাত্রাস,
আমি মহা প্রলয়ের দ্বাদশ রবির রাহু গ্রাস!
আমি কভূ প্রশান্ত কভূ অশান্ত দারুণ স্বেচ্ছাচারী,
আমি অরুণ খুনের তরুণ, আমি বিধির দর্পহারী!
আমি প্রভোন্জনের উচ্ছ্বাস
, আমি বারিধির মহা কল্লোল,
আমি উদ্জ্বল, আমি প্রোজ্জ্জ্বল,
আমি উচ্ছ্বল জল-ছল-ছল,
চল-ঊর্মির হিন্দোল-দোল!
আমি
বন্ধন-হারা কুমারীর বেণু,
তন্বী-নয়নে বহ্ণি
আমি ষোড়শীর হৃদি-সরসিজ প্রেম উদ্দাম, আমি ধন্যি!
আমি উন্মন মন উদাসীর,
আমি বিধবার বুকে ক্রন্দন-শ্বাস,
হা হুতাশ আমি হুতাশীর।
আমি বন্চিত ব্যথা পথবাসী
চির গৃহহারা যত পথিকের,
আমি অবমানিতের মরম বেদনা,
বিষ জ্বালা, প্রিয় লান্চিত বুকে গতি ফের
আমি অভিমানী চির ক্ষুব্ধ হিয়ার কাতরতা,
ব্যথা সুনিবিড়
চিত চুম্বন-চোর কম্পন
আমি থর-থর-থর প্রথম প্রকাশ কুমারীর!
আমি গোপন-প্রিয়ার চকিত চাহনি,
ছল-করে দেখা অনুখন,
আমি চপল মেয়ের ভালোবাসা,
তা’র কাঁকন-চুড়ির কন-কন!
আমি চির-শিশু, চির-কিশোর,
আমি যৌবন-ভীতু পল্লীবালার আঁচড় কাঁচলি নিচোর!
আমি উত্তর-বায়ু মলয়-অনিল উদাস পূরবী হাওয়া,
আমি পথিক-কবির গভীর রাগিণী,
বেণু-বীণে গান গাওয়া।
আমি আকুল নিদাঘ-তিয়াসা,
আমি রৌদ্র-রুদ্র রবি
আমি মরু-নির্ঝর ঝর ঝর, আমি শ্যামলিমা ছায়া-ছবি!
আমি তুরীয়ানন্দে ছুটে চলি, এ কি উন্মাদ আমি উন্মাদ!
আমি সহসা আমারে চিনেছি,
আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ!
আমি
উথ্থান, আমি পতন,
আমি
অচেতন-চিতে চেতন,
আমি বিশ্ব-তোরণে বৈজয়ন্তী, মানব-বিজয়-কেতন।
ছুটি ঝড়ের মতন করতালি দিয়া
স্বর্গ মর্ত্য-করতলে,
তাজী বোররাক আর উচ্চৈঃশ্রবা বাহন আমার
হিম্মত-হ্রেষা হেঁকে চলে!
আমি
বসুধা-বক্ষে আগ্নিয়াদ্রি, বাড়ব-বহ্ণি, কালানল,
আমি পাতালে মাতাল অগ্নি-পাথার-
কলরোল-কল-কোলাহল!
আমি তড়িতে চড়িয়া উড়ে চলি জোর
তুড়ি দিয়া দিয়া লম্ফ,
আমি ত্রাস সন্চারি ভুবনে সহসা সন্চারি ভূমিকম্প।
ধরি
বাসুকির ফণা জাপটি
ধরি স্বর্গীয় দূত জিব্রাইলের আগুনের পাখা সাপটি’।
আমি দেব শিশু, আমি চঞ্চল,
আমি ধৃষ্ট, আমি দাঁত দিয়া ছিঁড়ি বিশ্ব মায়ের অন্চল!
আমি অর্ফিয়াসের বাঁশরী,
মহা- সিন্ধু উতলা ঘুমঘুম
ঘুম চুমু দিয়ে করি নিখিল বিশ্বে নিঝঝুম
মম বাঁশরীর তানে পাশরি
আমি শ্যামের হাতের বাঁশরী।
আমি রুষে উঠি যবে ছুটি মহাকাশ ছাপিয়া,
ভয়ে সপ্ত নরক হাবিয়া দোজখ নিভে নিভে যায় কাঁপিয়া!
আমি বিদ্রোহ-বাহী নিখিল অখিল ব্যাপিয়া!
আমি
শ্রাবণ-প্লাবন-বন্যা,
কভু ধরনীরে করি বরণীয়া, কভু বিপুল ধ্বংস-ধন্যা-
আমি ছিনিয়া আনিব বিষ্ণু-বক্ষ হইতে যুগল কন্যা!
আমি অন্যায়, আমি উল্কা, আমি শনি,
আমি ধূমকেতু-জ্বালা, বিষধর কাল-ফণী!
আমি ছিন্নমস্তা চন্ডী, আমি রণদা সর্বনাশী,
আমি জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি!
আমি
মৃন্ময়, আমি চিন্ময়,
আমি অজর অমর অক্ষয়, আমি অব্যয়।
আমি মানব দানব দেবতার ভয়,
বিশ্বের আমি চির-দুর্জয়,
জগদীশ্বর-ঈশ্বর আমি পুরুষোত্তম সত্য,
আমি তাথিয়া তাথিয়া মাথিয়া ফিরি স্বর্গ-পাতাল মর্ত্য!
আমি উন্মাদ, আমি উন্মাদ!!
আমি চিনেছি আমারে,
আজিকে আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ!!
আমি
পরশুরামের কঠোর কুঠার
নিঃক্ষত্রিয় করিব বিশ্ব, আনিব শান্তি শান্ত উদার!
আমি হল বলরাম-স্কন্ধে
আমি উপাড়ি ফেলিব অধীন বিশ্ব
অবহেলে নব সৃষ্টির মহানন্দে।
মহা-বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত,
যবে উত্পীড়িতের ক্রন্দন-রোল
আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না
বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত।
আমি
বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে
এঁকে দিই পদ-চিহ্ন,
আমি স্রষ্টা-সূদন,
শোক-তাপ হানা খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন!
আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দেবো পদ-চিহ্ন!
আমি খেয়ালী-বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন!
আমি
চির-বিদ্রোহী বীর
বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির!
মা--
কাজি নজরুল ইসলাম
==========================
যেখানেতে দেখি যাহা
মা-এর মতন আহা
একটি
কথায় এত সুধা মেশা
নাই,
মায়ের
মতন এত
আদর
সোহাগ সে তো
আর
কোনখানে কেহ পাইবে ভাই!
হেরিলে
মায়ের মুখ
দূরে
যায় সব দুখ,
মায়ের
কোলেতে শুয়ে জুড়ায় পরান,
মায়ের
শীতল কোলে
সকল
যাতনা ভোলে
কত
না সোহাগে মাতা
বুকটি ভরান।
কত
করি উৎপাত
আবদার
দিন রাত,
সব
স’ন হাসি
মুখে, ওরে সে যে
মা!
আমাদের
মুখ চেয়ে
নিজে
র’ন নাহি
খেয়ে,
শত
দোষী তবু মা তো
তাজে না।
ছিনু
খোকা এতটুকু,
একটুতে
ছোট বুক
যখন
ভাঙিয়া যেতো, মা-ই
সে তখন
বুকে
করে নিশিদিন
আরাম-বিরাম-হীন
দোলা
দেয় শুধাতেন, ‘কি হোলো খোকন?’
আহা
সে কতই রাতি
শিয়রে
জ্বালায়ে বাতি
একটু
আসুখ হলে জাগেন মাতা,
সব-কিছু ভুলে গিয়ে
কেবল
আমায়ের নিয়ে
কত
আকুলতা যেন জাগন্মাতা।
যখন
জন্ম নিনু
কত
আসহায় ছিনু,
কাঁদা
ছাড়া নাহি জানিতাম কোন
কিছু,
ওঠা
বসা দূরে থাক-
মুখে
নাহি ছিল বাক,
চাহনি
ফিরিত শুধু আর পিছু
পিছু।
তখন
সে মা আমার
চুমু
খেয়ে বারবার
চাপিতেন
বুকে, শুধু একটি চাওয়ায়
বুঝিয়া
নিতেন যত
আমার
কি ব্যথা হোতো,
বল
কে ওমন স্নেহে
বুকটি ছাওয়ায়।
তারপর
কত দুখে
আমারে
ধরিয়া বুকে
করিয়া
তুলেছে মাতা দেখো কত
বড়,
কত
না সে সুন্দর
এ
দেহে এ অন্তর
সব
মোর ভাই বোন হেথা
যত পড়।
পাঠশালা
হ’তে যবে
ঘরে
ফিরি যাব সবে,
কত
না আদরে কোলে
তুলি’ নেবে মাতা,
খাবার
ধরিয়া মুখে
শুধাবেন
কত সুখে
কত
আজ লেখা হোলো,
পড়া কত পাতা?’
পড়া
লেখা ভাল হ’লে
দেখেছ
সে কত ছলে
ঘরে
ঘরে মা আমার কত
নাম করে।
বলে,
‘মোর খোকামনি!
হীরা-মানিকের খনি,
এমনটি
নাই কারো!’ শুনে বুক
ভরে।
গা’টি গরম হলে
মা
সে চোখের জলে
ভেসে
বলে, ‘ওরে যাদু কি
হয়েছে বল’।
কত
দেবতার ‘থানে’
পীরে
মা মানত মানে-
মাতা
ছাড়া নাই কারো চোখে
এত জল।
যখন
ঘুমায়ে থাকি
জাগে
রে কাহার আঁখি
আমার
শিয়রে, আহা কিসে হবে
ঘুম।
তাই
কত ছড়া গানে
ঘুম-পাড়ানীরে আনে,
বলে,
‘ঘুম! দিয়ে যা রে
খুকু-চোখে চুম’।
দিবানিশি
ভাবনা
কিসে
ক্লেশ পাব না,
কিসে
সে মানুষ হব,
বড় হব কিসে;
বুক
ভ’রে ওঠে
মা’র
ছেলেরি
গরবে তাঁর,
সব
দুখ হয় মায়ের আশিসে।
আয়
তবে ভাই বোন,
আয়
সবে আয় শোন
গাই
গান, পদধূলি শিরে লয়ে
মা’র;
মা’র বড়
কেহ নাই-
কেউ
নাই কেউ নাই!
নত
করি বল সবে ‘মা
আমার! মা আমার!’
মানুষ
নির্মলেন্দু গুল
====================
আমি হয়তো মানুষ নই, মানুষগুলো অন্যরকম,
হাঁটতে
পারে, বসতে পারে, এ-ঘর থেকে ও-ঘরে যায়,
মানুষগুলো
অন্যরকম, সাপে কাটলে দৌড়ে
পালায়।
আমি
হয়তো মানুষ নই, সারাটা
দিন দাঁড়িয়ে থাকি,
গাছের
মত দাঁড়িয়ে থাকি।
সাপে
কাটলে টের পাই না,
সিনেমা দেখে গান গাই
না,
অনেকদিন
বরফমাখা জল খাই না।
কী
করে তাও বেঁচে আছি
আমার মতো। অবাক
লাগে।
আমি
হয়তো মানুষ নই, মানুষ
হলে জুতো থাকতো।
বাড়ি
থাকতো, ঘর থাকতো,
রাত্রিবেলায়
ঘরের মধ্যে নারী থাকতো,
পেটের
পটে আমার কালো শিশু
আঁকতো।
আমি
হয়ত মানুষ নই,
মানুষ
হলে আকাশ দেখে হাসবো
কেন?
মানুষগুলো
অন্যরকম, হাত থাকবে,
নাক
থাকবে, তোমার মতো চোখ
থাকবে,
নিকেলমাখা
কী সুন্দর চোখ
থাকবে।
মানুষ
হলে উরুর মধ্যে দাগ
থাকতো,
চোখের
মধ্যে অভিমানের রাগ থাকতো,
বাবা
থাকতো, বোন থাকতো,
ভালবাসার
লোক থাকতো,
হঠাৎ
করে মরে যাবার ভয়
থাকতো।
আমি
হয়তো মানুষ নই,
মানুষ
হলে তোমাকে নিয়ে কবিতা
লেখা
আর
হতো না, তোমাকে ছাড়া
সারাটা রাত
বেঁচে-থাকাটা আর হতো
না।
মানুষগুলো
সাপে কাটলে দৌড়ে পালায়;
অথচ
আমি সাপ দেখলে এগিয়ে
যাই,
অবহেলায়
মানুষ ভেবে জাপটে ধরি।
বনলতা সেন
--জীবনানন্দ দাশ
============================
হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার-অশোকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরও দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দু-দন্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন ।
চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের পর
হাল ভেঙ্গে যে নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে
চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে;
বলেছে সে, 'এতদিন কোথায় ছিলেন?'
পাখির নীড়ের মত চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।
সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মত
সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;
পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পান্ডুলিপি করে আয়োজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;
সব পাখি ঘরে আসে - সব নদী –
ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।
![]() |
shabuj family |
ভালবাসা
মুহাম্মাদ জাফর ইকবাল
========================
যাদের আছে টাকা
সবাইকে দিতে তাদের পকেট হল ফাঁকা।
আমার কিছুই নেই
কেমন করে কাউকে কিছু দেই?
শুধু জানি বুকের ভিতর ঠাসা
আছে শুধু সলিড ভালোবাসা।
সেখান থেকে তোমায় দিলাম কিছু
যখন তুমি হেঁটে এলে আমার পিছু পিছু।
পথের পাশে ছোট মেয়েটা বিক্রি করে ফুল
তাকেও কিছু দিতে হল হয়নি কোনো ভুল।
বুকের থেকে ভালোবাসা খাবলা দিয়ে নেই
ছোট ভাইটা দুষ্টু ভারি তাকে কিছু দেই।
মা’কে দিলাম আঁচলখানা ভরে
বাবার জন্য ঢেলে দিলাম রইল যেটুক পড়ে।
ভেবেছিলাম দিয়ে থুয়ে সবই বুঝি যাবে
ভালোবাসা খুঁজলে পরে আর কিছু কই পাবে?
কিন্তু দেখো অবাক ব্যাপার কতো
যত দিচ্ছি কমছে না তো,বাড়তে থাকে তত!
বুকের ভেতর এক্কেবারে ঠাসা
নূতন করে জমা হল সলিড ভালোবাসা।
No comments:
Post a Comment